সোমবার, ১২ই মে ২০২৫, ২৯শে বৈশাখ ১৪৩২ | ই-পেপার
ব্রেকিং নিউজ:
  • সারাদেশে উপজেলা প্রতিনিধি নিয়োগ করা হচ্ছে। আগ্রহী হলে আপনার সিভি ই-মেইল করতে পারেন। ই-মেইল nagorikdesk@gmail.com
সংবাদ শিরোনাম:
  • আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সংহতি ও সহযোগিতার আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার
  • আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি
  • র‌্যাব পুনর্গঠন করা হবে, পুলিশের হাতে মারণাস্ত্র থাকবে না
  • প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে নেপালের ডেপুটি স্পিকার ইন্দিরা রানার সাক্ষাৎ
  • গেজেট এলে আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিল নিয়ে সিদ্ধান্ত হবে
  • দেশের ইতিহাসে গুমের সূচনা করেছে আওয়ামী লীগ
  • ফ্যাসিস্ট শাসকের পলায়নে গণতন্ত্রের প্রাথমিক বিজয় হয়েছে
  • স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন
  • শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে প্রতিবেদন জমা
  • মালিকানা হস্তান্তরের ক্ষমতা পেলো সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক

স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন জরুরি

সাঈদ খান

প্রকাশিত:
২৯ এপ্রিল ২০২৫, ১৪:৫৪

বাংলাদেশের মানবিকতা বিশ্বের সামনে আজ এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। কিন্তু এই মহানুভবতার অজুহাতে আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব যেন কখনো ক্ষুন্ন না হয়। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে কোনো আপস চলবে না। শান্তিপূর্ণ, সম্মানজনক ও টেকসই প্রত্যাবাসনই হতে হবে একমাত্র লক্ষ্য। বিশ্ব সম্প্রদায়ের সহযোগিতা এবং জাতীয় শক্তির দৃঢ়তায়, স্বাধীন বাংলাদেশের মর্যাদা অক্ষুন্ন রেখেই রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে হবে। ১৬ ও ১৭ এপ্রিল ইউনিফর্ম ও অস্ত্রধারী আরাকান আর্মি বাংলাদেশের সার্বভৌম সীমা লঙ্ঘন করে বান্দরবান জেলার থানচি উপজেলার তিন্দু ইউনিয়নের রেমাক্রি মুখ এলাকায় প্রায় ১০ কিলোমিটার ভেতরে অনুপ্রবেশ করে। সেখানে তারা স্থানীয় উপজাতিদের নিয়ে জলকেলি উৎসবের আয়োজন করে। উৎসবের সচিত্র ভিডিও পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করা হয়। এই আয়োজনে আরাকান আর্মির রাজনৈতিক শাখা ইউএলএ এবং স্থানীয় জনগণও অংশ নেয়। জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সঙ্গে কিছু ক্ষেত্রে মতের অমিল থাকলেও, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে তারা আরাকান আর্মির অনুপ্রবেশের ঘটনায় যে নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে, তার জন্য তাদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। অন্যদিকে, বামদলসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল এই গুরুতর বিষয়ে কোনো নিন্দা বা প্রতিবাদ জানায়নি যা দেখে আমি হতবাক হয়েছি। সবার মনে রাখতে হবে, দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে কোনো আপস নেই।

মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির অনুপ্রবেশ এবং স্থানীয় নেতৃত্বের উপস্থিতিতে প্রকাশ্যে জলকেলি উৎসব আয়োজন বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বে গুরুতর হুমকি এবং অবমাননা। বিজিবির উপস্থিতি থাকা সত্ত্বেও কোনো প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ না নেওয়া, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা নীতির ব্যর্থতা এবং প্রশাসনিক নিষ্ক্রিতার ইঙ্গিত দেয়। বিশেষজ্ঞদের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, এই আয়োজন ছিল আরাকান আর্মির দখলদার মানসিকতার প্রকাশ এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে তাদের সশস্ত্র উপস্থিতির ভিত্তি তৈরির চেষ্টা। স্থানীয় সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ, নেতৃত্বের সহযোগিতা এবং গোপন প্রশিক্ষণ-সংগঠনের বাস্তবতা থেকে স্পষ্ট, সেখানে একটি ছায়া-রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তুতি চলছে। আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের গণহত্যার অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও তাদের বাংলাদেশে ঢুকে উৎসব করা শুধু দুর্বলতা নয়, বরং নৈতিক ও নিরাপত্তাগত বিপর্যয়ের আশঙ্কা তৈরি করেছে। থানচির এই অঞ্চল বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সীমানার অভ্যন্তরে সরাসরি রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকা হওয়ায় আরাকান আর্মির কার্যক্রম বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার বিরুদ্ধে সুপরিকল্পিত চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এখনই কঠোর পদক্ষেপ না নিলে ভবিষ্যতে ভয়াবহ বিচ্ছিন্নতাবাদ ও সশস্ত্র সংঘাতের আশঙ্কা প্রবল হয়ে উঠবে। ১৬ এপ্রিল ২০২৫ তারিখে মার্কিন দুই উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী তিন দিনের সফরে বাংলাদেশে আসেন। তারা দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ছাড়াও বাংলাদেশের চীন, ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সাম্প্রতিক যোগাযোগ ও অবস্থান নিয়ে জানতে চান। মার্কিন প্রতিনিধিদল আরও জানতে চেয়েছিল, বাংলাদেশ কি মিয়ানমারের সামরিক সরকার ও আরাকান আর্মি উভয়ের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছে কি না? এছাড়া, চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সহযোগিতার প্রসঙ্গ উত্থাপন করা হলে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে চীনের কোনো সম্পৃক্ততার পরিকল্পনা নেই। ২৩ এপ্রিল ২০২৫, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, শরণার্থী হিসেবে দীর্ঘ অবস্থান রোহিঙ্গাদের মধ্যে হতাশা বাড়াচ্ছে। তারা নানা রকম অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়াচ্ছে। দ্রুত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন না হলে পুরো অঞ্চল অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে। বাংলাদেশ মনে করে, চলমান সংকটের একমাত্র সমাধান রোহিঙ্গাদের টেকসই প্রত্যাবাসন।

জাতিগত নিধন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায় কোনোভাবেই শাস্তির বাইরে থাকতে পারে না। এজন্য আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে চলমান প্রক্রিয়াকে সমর্থন করে বাংলাদেশ। মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে মিয়ানমারের বিচারই হতে পারে রাখাইনে ফিরতে রোহিঙ্গাদের আস্থা। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে আন্তর্জাতিক মহলে চাপ বাড়াতে কাতারের প্রতি আহ্বান জানান ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ওআইসিভুক্ত দেশগুলোকে সক্রিয় করতে কাতারকে এগিয়ে আসতে বলেন তিনি। এর আগে গত ১৫ মার্চ ২০২৫, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এবং জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস কক্সবাজারের উখিয়ায় শরণার্থী শিবিরে প্রায় এক লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর সঙ্গে ইফতার করেছেন। ৮ এপ্রিল ২০২৫, ড. খলিলুর রহমান বলেছেন, ‘আরাকানে বর্তমানে যে যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে, তার নিরসন না করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন হচ্ছে না। এক লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফিরিয়ে দেওয়ার বন্দোবস্ত করতে পারব। তবে সেটা কালকেই হচ্ছে না। তারা যাতে দ্রুততর সময়ে যেতে পারেন, আমাদের সেই প্রচেষ্টা থাকবে। সে কারণে মিয়ানমার, আরাকানের প্রকৃত ও বাস্তব কর্র্তৃপক্ষ, জাতিসংঘ এবং আমাদের বন্ধু দেশগুলোর সঙ্গে মিলে আমরা কাজটি করব। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন যে, আগামী ঈদ যাতে রোহিঙ্গারা তাদের দেশে গিয়ে করতে পারেন, সেটাই আমাদের লক্ষ্য। জাতিসংঘের মহাসচিব এখানে একটি একটি আন্তর্জাতিক হিউম্যানিটারিয়ান করিডরের কথা বলেছিলেন। এ নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান কী, প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, করিডর কথাটি তিনি বলেননি, চ্যানেল বলেছেন। করিডরের একটি আইনগত মানে আছে, যে কারণে তিনি এটি অ্যাভয়েড করেছেন। আমাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলেই তিনি এটা বলেছেন।’

গত তিন দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে সামরিক সহযোগিতা বাড়াতে আগ্রহ দেখিয়েছে এবং এ সময় বাংলাদেশের কিছু স্থানে ‘লজিস্টিক সাপোর্ট’, ‘ট্রেনিং বেস’ অথবা ‘রিফুয়েলিং স্টেশন’ নির্মাণের আগ্রহের কথা বলেছিল। বিশেষ করে, সেন্টমার্টিন দ্বীপ বা কক্সবাজারের দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ ছিল ‘কৌশলগত প্রবেশপথ’ তৈরি করার বিষয়ে। বিশেষ করে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক (বড় বড় প্রকল্পে) বাড়ার পর, বাংলাদেশ সরকার মার্কিন সামরিক উপস্থিতির প্রস্তাবকে অপ্রকাশ্যে বা নরমভাবে ঠেকিয়ে দিয়েছে। বর্তমানে ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশ তার ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর কৌশলগত আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। বিশেষত বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরের সংযোগস্থলে অবস্থিত হওয়ায়, বাংলাদেশকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারতসহ বেশ কয়েকটি শক্তির বিশেষ কৌশলগত পরিকল্পনা রয়েছে। বামপন্থিদের মধ্যে একটি কথা প্রচলিত আমেরিকার বন্ধুত্ব অনেক সময় আশীর্বাদ নয়, বরং বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তখন শুরু হয় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, চাপ, অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা, এমনকি সরকার বদলের চেষ্টা। ইতিহাসে চিলি, ইরাক, আফগানিস্তান, ইরান, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম ও পানামা তার স্পষ্ট উদাহরণ। এই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে বলতে চাই, প্রতিদিন মৃত্যু বিক্রির অস্ত্র উৎপাদন বন্ধ করুন। ফিলিস্তিনে গণহত্যা বন্ধ করুন। মানুষ হত্যার হিংস্র রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসুন। জাত-ধর্মের বিভাজনের বিষ ছড়ানো আর নয়। সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও মৌলবাদ তৈরির কারখানা বন্ধ করুন। নিরাপদ পৃথিবী ও মানবকল্যাণের পথে এগিয়ে চলুন।

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় বিজয়ের পর বাংলাদেশ যখন একটি নবীন রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ করে, তখন শুরু হয় আন্তর্জাতিক চাপ, প্রভাব ও নানা হুমকির কঠিন বাস্তবতা মোকাবিলার সংগ্রাম। সেই চ্যালেঞ্জিং সময়ে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এক সাহসী দিশারীর ভূমিকায় আবির্ভূত হন। দূরদর্শী নেতৃত্ব ও অটুট আত্মবিশ্বাস নিয়ে তিনি বাংলাদেশকে আত্মমর্যাদাসম্পন্ন, স্বাধীন ও সার্বভৌম পররাষ্ট্রনীতির পথে এগিয়ে নিতে উদ্যোগী হন। তবে এই মহান প্রয়াস, এই অকুণ্ঠ অঙ্গীকারের জন্যই তাকে শেষ পর্যন্ত জীবন উৎসর্গ করতে হয়। জিয়াউর রহমানের পররাষ্ট্রনীতির মূল দর্শন ছিল ‘সব দেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’। তিনি গভীর বিশ্বাসে দৃঢ় ছিলেন যে, বাংলাদেশ কোনো পরাশক্তির উপনিবেশ কিংবা আধিপত্যের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হবে না। মুক্তিযুদ্ধের যে আদর্শ ও চেতনায় জাতির অভ্যুদয় ঘটেছিল, সেটার পূর্ণ বাস্তবায়নই ছিল তার দৃপ্ত অঙ্গীকার। আজ শহীদ জিয়াউর রহমানের সেই আদর্শিক উত্তরসূরি হিসেবে তারেক রহমান দৃঢ় প্রত্যয়ে এগিয়ে চলেছেন। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং জনগণের ভোটাধিকার, গণতন্ত্র ও মৌলিক অধিকার পুনরুদ্ধারের সংগ্রাম অব্যাহত রয়েছে। ভোটাধিকার, গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সাড়ে পনেরো বছরের দীর্ঘ লড়াই যেখানে বিএনপি, জামায়াতসহ অন্যান্য গণতান্ত্রিক শক্তির প্রতিবাদ, হাজার হাজার রাজনৈতিক নেতাকর্মীর আত্মত্যাগ এবং ছাত্র-জনতার রক্তাক্ত গণঅভ্যুত্থানে হাজারো প্রাণের বিসর্জন এই সব কি বৃথা যাবে? না, কখনোই বৃথা যাবে না। আমরা হতে দেব না। শহীদদের রক্তের শপথ নিয়ে এ দেশের ছাত্র-জনতা ও সব দেশপ্রেমিক এবং গণতন্ত্রকামী রাজনৈতিক দল ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করবেই।


লেখক: সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক সাংগঠনিক সম্পাদক, ডিইউজে


মন্তব্য করুন:

সম্পর্কিত খবর