সোমবার, ১২ই মে ২০২৫, ২৯শে বৈশাখ ১৪৩২ | ই-পেপার
ব্রেকিং নিউজ:
  • সারাদেশে উপজেলা প্রতিনিধি নিয়োগ করা হচ্ছে। আগ্রহী হলে আপনার সিভি ই-মেইল করতে পারেন। ই-মেইল nagorikdesk@gmail.com
সংবাদ শিরোনাম:
  • আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সংহতি ও সহযোগিতার আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার
  • আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি
  • র‌্যাব পুনর্গঠন করা হবে, পুলিশের হাতে মারণাস্ত্র থাকবে না
  • প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে নেপালের ডেপুটি স্পিকার ইন্দিরা রানার সাক্ষাৎ
  • গেজেট এলে আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিল নিয়ে সিদ্ধান্ত হবে
  • দেশের ইতিহাসে গুমের সূচনা করেছে আওয়ামী লীগ
  • ফ্যাসিস্ট শাসকের পলায়নে গণতন্ত্রের প্রাথমিক বিজয় হয়েছে
  • স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন
  • শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে প্রতিবেদন জমা
  • মালিকানা হস্তান্তরের ক্ষমতা পেলো সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক

৩১ দফায় কৃষক-শ্রমিকের অধিকার কতটুকু?

সাঈদ খান

প্রকাশিত:
১ মে ২০২৫, ১১:৫৫

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ৩১ দফা একটি গুরুত্বপূর্ণ দিশারি, যা শুধু বিএনপির নয়, দেশের সব রাজনৈতিক দলের চিন্তা-ভাবনা থেকে প্রণীত একটি যুগোপযোগী কর্মসূচি। এটি দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য একটি সার্বিক ও সুসংগঠিত রূপরেখা, যেখানে জনগণের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ তুলে ধরা হয়েছে, যেমন গণতন্ত্রের সুরক্ষা, শিক্ষা সংস্কার, স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন, কৃষক-শ্রমিক অধিকার, মানবাধিকার, সামাজিক ন্যায়বিচার, দুর্নীতি দমন ও কৃষির উন্নতি। যা দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনার মডেল হিসেবে এবং ভবিষ্যত উন্নয়নে অগ্রগামী ভূমিকা রাখবে।

বিএনপির ঘোষিত ৩১ দফা রূপরেখায় কৃষক-শ্রমিকের অধিকারকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। দলটি অঙ্গীকার করেছে, শিল্পশ্রমিক, গার্মেন্টস শ্রমিক, কৃষিশ্রমিক, নির্মাণ শ্রমিক, পরিবহণ শ্রমিক, চা-শ্রমিক, রিকশাচালক, দিনমজুর ও গৃহকর্মীদের মৌলিক অধিকার, মর্যাদা ও জীবনমান রক্ষায় উপযুক্ত আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা হবে। জীবিকার উপযোগী ও সম্মানজনক জীবনযাত্রার জন্য ন্যূনতম মজুরি কাঠামো নিশ্চিত করা হবে।

শ্রমিকদের জন্য নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা হবে। গার্মেন্টসসহ উৎপাদন খাতের শ্রমিকদের জন্য চিকিৎসা, মাতৃত্বকালীন ছুটি, আবাসন ও শিশুশিক্ষা সুবিধা দেওয়া হবে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার কনভেনশন অনুযায়ী শ্রম আইন সংস্কার করে সংগঠন, ধর্মঘট ও যৌথ দরকষাকষির অধিকার প্রতিষ্ঠা করা হবে।

অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের স্বীকৃতি দিয়ে পূর্ণাঙ্গ সুরক্ষা কাঠামো গঠনের পরিকল্পনা রয়েছে। জাতীয় শ্রমিক কল্যাণ তহবিল গঠন করে দুর্ঘটনাজনিত কারণে আহত শ্রমিকদের আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে। বিএনপি মনে করে, শ্রমজীবী মানুষের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করা ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনের জন্য অপরিহার্য।

বিএনপির ৩১ দফা রূপরেখায় শ্রমিকদের অধিকার, নিরাপত্তা, সংগঠন ও মর্যাদা নিয়ে একটি সুসংগঠিত ও মানবিক প্রতিশ্রুতি রয়েছে, যা বাস্তবায়ন হলে শ্রমজীবী মানুষের জীবনমান উন্নয়নের পথ সুগম হবে।

২৬ নং দফায় ‘ফ্যামিলি কার্ড প্রবর্তন’ করার কথা বলা হয়েছে, যা দেশের প্রতিটি পরিবারকে খাদ্যনিরাপত্তা ও কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে সহায়তা করবে। এই কার্ডের মাধ্যমে প্রতিটি পরিবারের মা অথবা গৃহিণীকে একটি পরিচয়পত্র প্রদান করা হবে, যা তাদের খাদ্যসামগ্রীর কিছু অংশ বিনামূল্যে সরবরাহ করবে। প্রাথমিকভাবে, এই প্রকল্পের আওতায় আসবে গ্রামের সুবিধাবঞ্চিত পরিবারগুলো, তবে পরবর্তীতে এটি শহর, থানা, উপজেলা এবং জেলা পর্যায়ে সম্প্রসারিত হবে।

এছাড়াও এই দফায় স্বাস্থ্যসেবা প্রবর্তন করে সবার জন্য স্বাস্থ্য কার্ড চালু করা উল্লেখ রয়েছে। যা দারিদ্র্য বিমোচন না হওয়া পর্যন্ত সুবিধাবঞ্চিত হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী ভূমিকা রাখবে।

২৫ নং দফায় বলা হয়েছে, ‘বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু নয়’ এই নীতি দেশের মানুষের মৌলিক মানবাধিকার সুরক্ষায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। কেউ যেন শুধু অর্থের অভাবে চিকিৎসা না পেয়ে মারা না যায়, সেদিকে বিশেষ নজর দেওয়া হবে। দেশের সকল অঞ্চলে চিকিৎসা সেবা সহজলভ্য করতে স্বাস্থ্য কেন্দ্র, হাসপাতাল ও ক্লিনিক গড়ে তোলা হবে, যাতে প্রত্যেক নাগরিক দ্রুত এবং কার্যকর চিকিৎসা পায়। এর মাধ্যমে সেবার অভাবের কারণে কোনো ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করবে না, এমন একটি সুস্থ সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব হবে। স্বাস্থ্যকে সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করে ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ ও ‘বিনা চিকিৎসায় কোনো মৃত্যু নয়’ এই নীতির ভিত্তিতে যুক্তরাজ্যের আদলে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা হবে। এতে শ্রমিক, কৃষক, দিনমজুর ও গরীব মানুষ চিকিৎসা সেবার সুবিধা পাবে এবং তারা সমাজের মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত হতে সক্ষম হবে।

২৩ নং দফায় বলা হয়েছে, নারীদের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার মাধ্যমে তাদের শক্তি, দক্ষতা এবং সম্ভাবনাকে উন্নয়নের দিকে পরিচালিত করা জন্য বিশেষভাবে প্রণীত ‘উন্নয়ন পরিকল্পনা’ নারী ও শিশুর জীবনমানের উন্নতি করতে সাহায্য করবে, যা দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিকাশে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। জাতীয় সংসদে নারীদের প্রাধান্য দেওয়ার মাধ্যমে নারীর রাজনৈতিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হবে। এটি গণতান্ত্রিক প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধি করবে এবং নারীদের প্রভাবশালী অবস্থানে রাখার সুযোগ তৈরি করবে। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করার মাধ্যমে, দেশব্যাপী উন্নয়ন পরিকল্পনায় নারীর সক্রিয় ভূমিকা নিশ্চিত করা হবে। নারী শ্রমিকদের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় কর্মসূচি গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করা হবে।

২২ নং দফায় বলা হয়েছে, শিক্ষিত বেকারদের বেকার ভাতা প্রদান করা হবে এবং বেকারত্ব দূরীকরণের লক্ষ্যে কার্যকর কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে। সরকারের পক্ষ থেকে যুবসমাজের জন্য একটি আধুনিক, যুগোপযোগী যুব-উন্নয়ন নীতিমালা প্রণয়ন করা হবে, যার মাধ্যমে বেকার যুবকদের স্থায়ী কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা হবে।

এই পদক্ষেপের মাধ্যমে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিত যুবকেরা যারা আজ বেকারত্বের কারণে হতাশ, তাদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে একটি সহায়ক হাত বাড়ানো হবে, যা তাদের আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনবে এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

বাংলাদেশে বেকারত্ব একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সমস্যা। কোনো দেশের জনশক্তির তুলনায় কর্মসংস্থানের স্বল্পতার ফলে সৃষ্ট সমস্যাই বেকার সমস্যা। কর্মহীন এই বিশাল উদ্বৃত্ত জনশক্তি না পারছে দেশের অর্থনীতিতে কোনো অবদান রাখতে, না পারছে নিজের সুন্দর-সমৃদ্ধ ভবিষ্যত নির্মাণ করতে। বেকারত্বের অসহ্য যন্ত্রণায় তারা জড়িয়ে পড়েছে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ডে। ফলে সর্বত্র দেখা দিচ্ছে বিশৃংখলা।

অর্থনীতির ভাষায়, ‘বেকারত্ব বলতে এমন একটি পরিস্থিতিকে বোঝায়, কর্মক্ষম মানুষ চলতি মজুরিতে কর্মে যোগদানে ইচ্ছুক হওয়া সত্ত্বেও কর্মে নিয়োগ লাভ করতে পারে না।’ বর্তমানে দেশের মোট কর্মক্ষম জনসংখ্যার ৪০ ভাগ বেকারত্বের অভিশাপ নিয়ে বসবাস করছে। বেকারত্ব দূর করতে প্রশিক্ষণ, উদ্যোক্তা পছন্দ এবং দক্ষতা বৃদ্ধি কার্যক্রম গ্রহণের পাশাপাশি সরকারি ও বেসরকারি খাতে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা জরুরি। সঠিক নীতি এবং কর্মসূচির মাধ্যমে এটি মোকাবিলা করা সম্ভব।

১৬ নং দফায় বলা হয়েছে মুদ্রাস্ফীতির প্রেক্ষিতে শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করা হবে। শিশুশ্রম নিষিদ্ধ করে তাদের জন্য উপযোগী পরিবেশ ও ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। নিরাপদ কর্মপরিবেশ এবং গণতান্ত্রিক ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার নিশ্চিত করা হবে। বন্ধ পাটকল, বস্ত্রকল ও চিনিকল পুনরায় চালু করা হবে। প্রবাসী শ্রমিকদের জীবন, মর্যাদা ও কর্মের নিরাপত্তা এবং বিমানবন্দরসহ দেশে হয়রানিমুক্ত সেবা ও ভোটাধিকার নিশ্চিত করা হবে। চা-বাগান, বস্তি, চরাঞ্চল, হাওর-বাঁওড়, উপকূল ও মঙ্গাপীড়িত অঞ্চলের বৈষম্য দূরীকরণে বিশেষ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হবে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে শ্রমজীবী জনগণের মৌলিক অধিকার ও সুযোগের সমতা নিশ্চিত করা। যুব উন্নয়নে যুগোপযোগী নীতিমালা প্রণয়ন, দক্ষতা বৃদ্ধি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পুষ্টিতে বিনিয়োগের মাধ্যমে মানবসম্পদ গড়ে তোলা হবে। আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধির বিষয়টি বিবেচনায় আনা হবে।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম প্রধান চালিকা শক্তি হলো গার্মেন্টস খাত। বিশ্বের সবচেয়ে বড় পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত বর্তমানে মোট বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রায় ৮৪% সরবরাহ করে। এই খাতে প্রায় ৫০ লাখেরও বেশি শ্রমিক কাজ করছে, যেখানে অধিকাংশই নারী শ্রমিক (প্রায় ৮০ ভাগ)। অধিকাংশ শ্রমিক অতিরিক্ত কাজের (ওভার টাইম) মাধ্যমে আয় বৃদ্ধি করে থাকেন।

২০২৩ সালের নভেম্বরে গ্রেড ভেদে শ্রমিকদের মজুরি আগের তুলনায় সর্বনিম্ন ৫৪ থেকে সর্বোচ্চ ৫৬ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। পোশাক শ্রমিকেরা সর্বনিম্ন ২৩ হাজার টাকা মজজুরর দাবিতে আন্দোলন করে আসছিলেন। মজুরি কাঠামোয় ১ নম্বর গ্রেডে পোশাক শ্রমিকদের সর্বোচ্চ মোট মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে ১৪ হাজার ৭৫০ টাকা, যা আগে ছিল ৯ হাজার ৫৯০ টাকা। সেই হিসাবে ৫ বছরের ব্যবধানে এ গ্রেডে মোট মজুরি বেড়েছে ৫ হাজার ১৬০ টাকা। আর চলমান বাজার মূল্য হিসেব করলে দেখা যাবে পূর্বের তুলনায় একটাও বাড়েনি।

এতে তৃতীয় গ্রেডে ১৪ হাজার ৭৫০টাকা, চতুর্থ গ্রেডে ১৪ হাজার ১৫০টাকা, পঞ্চম গ্রেডে ১৩ হাজার ৫৫০টাকা, ৬ষ্ঠ গ্রেডে ১৩ হাজার ২৫ টাকা, সপ্তম গ্রেডে ১২ হাজার ৫০০ টাকা ঘোষণা করা হয়েছে।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রবাসী শ্রমিকদের রেমিটেন্স অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান মাধ্যমগুলোর একটি। রেমিটেন্স বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (এউচ) প্রায় ৭-১০% জুড়ে রয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রবাসীরা প্রায় ২২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন। রেমিটেন্স অর্থনীতিতে সরাসরি বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বৃদ্ধি করে, যা আমদানি খরচ পূরণে সহায়তা করে।

২০২৩ সালে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো বা বিএইটি-র তথ্য মতে, বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় দেড় কোটি। তবে এ সংখ্যা বর্তমানে আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতি বছর প্রায় ৭-১০ লাখ নতুন শ্রমিক বিদেশে যান, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে। ২০২৪ সালের তথ্য অনুযায়ী, প্রবাসী শ্রমিকদের মধ্যে নারী প্রবাসী শ্রমিক রয়েছেন প্রায় ১৫-২০ লক্ষ। প্রবাসী শ্রমিকরা বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদ- হিসেবে বিবেচিত হলেও তারা বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে কাজ করেন। দক্ষতার ঘাটতি এবং সুরক্ষার অভাব এই পেশার প্রধান সমস্যা।

বাংলাদেশের চা-শিল্প একটি ঐতিহ্যবাহী এবং গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক খাত। বাংলাদেশে বর্তমানে ১৬৭ চা-বাগান রয়েছে। এসব বাগানে মোট জমির পরিমাণ ২,৭৯, ৪৩৯ একর। চা উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে নবম। ২০১৯ সালে বাংলাদেশে ৯ কোটি ৬০ লাখ ৬৯ হাজার কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে। দেশে চায়ের বাজারের আকার সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। প্রায় ৭ লাখ চা জনগোষ্ঠীর মধ্যে নিবন্ধিত শ্রমিক প্রায় ৯৭ হাজার ৭০০ জন। অনিয়মিত শ্রমিক প্রায় আরও ৪০ হাজার। দেশের চা-চাষ পৌনে দুইশত বছর পার করলেও চা-শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ১৭০ টাকার বেশি হয়নি। বসবাসের জন্য ১৬ হাজার পাকাঘর বরাদ্দ আছে রেজিস্টার্ড শ্রমিকদের জন্য। আর প্রায় ৪৫ হাজার শ্রমিকের জন্য রয়েছে কাঁচাঘর। রেজিস্টার্ড ও অস্থায়ী শ্রমিক মিলিয়ে প্রায় ৭৫ হাজার শ্রমিকের মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। প্রতিটি বাগানে প্রাইমারি স্কুল থাকার কথা থাকলেও বাগান কর্তৃপক্ষের প্রতিষ্ঠিত স্কুল সংখ্যা মাত্র ১১৮টি। স্কুলগুলোতে ২৫ হাজার ৯৬৬ জন শিক্ষার্থীর জন্য রয়েছেন এবং মাত্র ৩৬৬ জন শিক্ষক। আর শিক্ষকরা অষ্টম থেকে নবম শ্রেণি পাস। চা-বাগানগুলোতে চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা খুবই নাজুক। অভিজ্ঞ বা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ধাত্রী না থাকায় চা-বাগানগুলোতে মাতৃমৃত্যুর হার অপেক্ষাকৃত বেশি। ১৯৬২ সালের ‘টি প্ল্যান্টেশন লেবার অর্ডিন্যান্স’ এবং ১৯৭৭ সালের ‘প্ল্যান্টেশন রুলস’ অনুযায়ী শ্রমিকদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার দায়িত্ব মালিকরা পালন করছেন না। চা-জনগোষ্ঠীর শিক্ষিত তরুণদের বেকারত্ব দুর্বিষহ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। নারী চা-শ্রমিকরা নিপীড়িতদের মধ্যে নিপীড়িত।

১৪ নম্বর দফার বক্তব্য বলা হয়েছে, অর্থনীতি একটি দেশের মূলস্তম্ভ। এর উন্নয়নে সুনির্দিষ্ট, দূরদর্শী ও বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ গ্রহণ অপরিহার্য। এজন্য একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক সংস্কার কমিশন গঠন করা হবে, যার দায়িত্ব হবে দেশের প্রধান অর্থনৈতিক খাত কুষি, শিল্প, বাণিজ্য ও উৎপাদনব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে পরিকল্পনা, নীতি ও কার্যকর সুপারিশ প্রদান করা।

কৃষির আধুনিকায়ন, প্রযুক্তি ব্যবহার এবং মানসম্পন্ন কৃষি উপকরণের সহজপ্রাপ্যতা নিশ্চিত করে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন সাধিত হবে। একইসঙ্গে ক্ষুদ্র, মাঝারি ও ভারী শিল্পের বিকাশে সহায়ক নীতি গ্রহণ এবং উৎপাদন বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

বিশ্ব বাজারে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকতে গার্মেন্টস শিল্পকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে রপ্তানি বৃদ্ধি করা হবে। কর্মক্ষম জনসংখ্যার দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে কর্মসংস্থান বাড়ানো হবে। বাণিজ্যিক উদারনীতি অনুসরণ করে বেসরকারি বিনিয়োগ উৎসাহিত করা হবে এবং সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে বন্ধ শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো পুনরায় চালু করা হবে।

সুষম অর্থনৈতিক উন্নয়ন, ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য হ্রাস এবং মৌলিক অর্থনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করতে কমিশন প্রয়োজনীয় সুপারিশ দেবে এবং বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা হবে। এভাবে আত্মনির্ভরশীল অর্থনীতি গড়ে উঠবে, যা মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্র সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারÑ প্রতিষ্ঠার পথকে সুদৃঢ় করবে।

বিএনপি সরকার গঠন করলে, বিশেষজ্ঞ অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকার, করপোরেট নেতা ও অভিজ্ঞ প্রশাসকদের সমন্বয়ে একটি কার্যকর সংস্কার কমিশন গঠন করা হবে, যা জনগণের আকাক্সক্ষা অনুযায়ী অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় নিরন্তর কাজ করবে।

বাংলাদেশে সর্বশেষ জনশুমারি হয় ২০২২ সালে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) অনুসারে, মোট জনসংখ্যা ১৭ কোটি ১৫ লাখ ৯০ হাজার। এরমধ্যে ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী ১১ কোটির বেশি, যা মোট জনসংখ্যার ৬৫ শতাংশ। ১৫ বছরের নিচে ও ৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ৬ কোটির বেশি, যা ৩৫ শতাংশ।

বাংলাদেশ যুব ইউনিয়নের মতে, দেশের ১ কোটি ১০ লক্ষ প্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিক, ২ কোটি ৩০ লক্ষ কৃষি শ্রমিক এবং প্রায় ৩ কোটি অন্যান্য শ্রমজীবী মানুষের কেউই রাষ্ট্রীয় আর্থিক, সামাজিক বা স্বাস্থ্যগত সুরক্ষা পাচ্ছেন না। সাধারণ মানুষ আরও নিঃস্ব হচ্ছে; ৫% লুটেরা ধনীর বিপরীতে ৯৫% সাধারণ মানুষ। এক চতুর্থাংশ কর্মক্ষম মানুষের পূর্ণকালীন কাজ নেই। উচ্চশিক্ষিত যুবদের ৪০% বেকার। ৭২% মানুষের আয় কমেছে। বিগত সরকারের দুর্নীতি, ব্যাংক লুট ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের লুণ্ঠনের ফলে শিল্পকারখানা গড়ে উঠেনি, যে কারণে কর্মসংস্থান নিশ্চিত হয়নি।

২৩ এপ্রিল ২০২৫, তারেক রহমান বলেছেন, ‘কৃষকদের জন্য ফারমার্স কার্ড আনা হবে। এ কার্ডে কৃষকের নাম, জমির পরিমাণ, দাগ নম্বরসহ অনেক কিছু থাকবে। লোন নিতে গিয়ে এখন কৃষকদের ভোগান্তির মুখে পড়তে হয়। কৃষকের ঋণ দরকার হলে তথ্যের জন্য কৃষি ব্যাংক সেখানে এক্সেস করতে পারবে। কোনো দালালের দরকার হবে না। প্রতি বছর একজন কৃষককে একটি ফসল চাষের খরচ বাবদ পুরোপুরি সহায়তা করা হবে। এক কৃষক বছরে তিন বা দুই ধরনের ফসল করলে একটা ফসলের ফুল সাপোর্ট আমরা দিতে চাই। এটা প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষককে দিয়ে আমরা শুরু করব।’

বিএনপির ৩১ দফায় শ্রমিক-কৃষক অধিকার ও স্বার্থ রক্ষার যে প্রতিশ্রুতি রয়েছে, তা বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ শ্রমিক-কৃষক অধিকার রক্ষায় বিশ্বমানের একটি আদর্শ রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পাবে এবং অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

১ মে, শুধু একটি তারিখ নয় এটি বিশ্ব শ্রমিক শ্রেণির ঐক্য, সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের প্রতীক। ১৮৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোর হে মার্কেট স্কয়ারে ৮ ঘণ্টা কর্মদিবসের দাবিতে আন্দোলনে বহু শ্রমিক, বেসামরিক ব্যক্তি ও পুলিশ নিহত হন। এ আন্দোলনের নেতাদের মধ্যে চারজনকে ফাঁসি দেওয়া হয়। এই রক্তাক্ত ইতিহাসই পৃথিবীব্যাপী শ্রমিকদের ঐক্য ও সংগ্রামের অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠে। ১৮৮৯ সালে প্যারিসে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক কংগ্রেস ১ মে কে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস ঘোষণা করে। ১৮৯০ সাল থেকে এই দিনটি বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে।

মে দিবসের মূল দাবি ছিল ৮ ঘণ্টা কাজ, ৮ ঘণ্টা বিশ্রাম এবং ৮ ঘণ্টা নিজের ও পরিবারের জন্য সময়। এটি শ্রমিকের মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। পুঁজিবাদী শোষণের বিরুদ্ধে শ্রমিকের প্রতিবাদের এক ঐতিহাসিক দিন হলো মে দিবস।

শ্রম অধিকার শ্রমজীবী মানুষের মৌলিক মানবাধিকার যার মধ্যে রয়েছে কর্মপরিবেশ, ন্যায্য মজুরি, সংগঠনের স্বাধীনতা, নিরাপত্তা ও সামাজিক সুরক্ষা। এটি আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার ঘোষিত মৌলিক অধিকার। কার্ল মার্ক্স শ্রমকে শুধু জীবিকার মাধ্যম হিসেবে নয়, বরং মানুষের আত্মপ্রকাশ ও সৃজনশীলতার উপায় হিসেবে দেখেছেন। তার মতে, ‘শ্রমিক ও পুঁজিপতির মধ্যকার দ্বন্দ্বই মানব সমাজের বিকাশের চালিকাশক্তি।’

বাংলাদেশের গার্মেন্টস, নির্মাণ, পরিবহনসহ বিভিন্ন খাতে কোটি শ্রমিক কাজ করছেন, অথচ এখনো তারা ন্যায্য মজুরি, নিরাপদ কর্মপরিবেশ ও সংগঠনের স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত। এই বাস্তবতায় মে দিবস শ্রমিক অধিকারের লড়াইয়ে আমাদের অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠে। এটি মনে করিয়ে দেয় শ্রমিকের ঘামই সমাজের চালিকাশক্তি, আর সেই শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা না হলে কোনো সভ্যতা টিকে থাকতে পারে না। মহান মে দিবস তাই শুধু অতীতের গৌরব নয়, বর্তমান ও ভবিষ্যতের দৃঢ় প্রতিশ্রুতিও।

লেখক : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সাংগঠনিক সম্পাদক, ডিইউজে

 


মন্তব্য করুন:

সম্পর্কিত খবর