শুক্রবার, ৬ই জুন ২০২৫, ২২শে জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ | ই-পেপার
ব্রেকিং নিউজ:
  • সারাদেশে উপজেলা প্রতিনিধি নিয়োগ করা হচ্ছে। আগ্রহী হলে আপনার সিভি ই-মেইল করতে পারেন। ই-মেইল nagorikdesk@gmail.com
সংবাদ শিরোনাম:
  • ডিসিপ্লিন মানলেই নিয়ন্ত্রণে থাকবে যানজট-আইনশৃঙ্খলা
  • দুর্নীতিবাজরা নেই, তাই গরুর দাম কম
  • তেলের দাম কমানো হয়েছে, বাসে বাড়তি ভাড়া নিলেই ব্যবস্থা
  • বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা পেল সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল
  • চার দিনের সফরে যুক্তরাজ্য যাচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা
  • গুমের ঘটনা নিয়ে একটি হরর মিউজিয়াম হওয়া উচিত
  • শেখ মুজিব ও ৪ নেতার মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি বাতিলের খবর সঠিক নয়
  • ভারত থেকে ‘পুশ ইন’ ঠেকানো সম্ভব নয়
  • ৪ শতাধিক রাজনীতিবিদের মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি বাতিল
  • ঈদের আগে শেষ কর্মদিবস আজ, কাল থেকে লম্বা ছুটি

শিশুর শৈশবকে হত্যা করছে শিক্ষার অব্যবস্থাপনা!

মো: তানজিমুল ইসলাম

প্রকাশিত:
১ জুন ২০২৫, ১৭:০৮

ডিজিটাল সভ্যতার এ ব্যস্ত সময়ে আজকের শিশুদের শৈশবকে হত্যা করছে শিক্ষার অব্যবস্থাপনা। আমাদের দেশের শিশুরা ভুমিষ্ঠ হবার পর থেকেই একটা অনিরাপদ ও বৈষম্যমূলক পরিবেশের মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠে। নিদেন পক্ষে বর্তমান যুগের একক পরিবারগুলোতেও শিশু বান্ধব পরিবেশের এক বেহাল দশা পরিলক্ষিত হয়! কেবল মাত্র অভাবগ্রস্ত প্রান্তিক শিশুরাই নয় বরং অট্টালিকার চার দেয়ালের মাঝে বন্দী শিবিরে বেড়ে ওঠা অভিজাত শিশুদের আক্ষেপের কথাগুলি শুনলে অনেক বেশি শিহরিত হতে হয়। কাগজে-কলমে ‘শিশু-সুরক্ষা’ আর ‘শিশু অধিকারের’ শ্লোগান শুনে শিশুরা আজ বড্ড ক্লান্ত! আধুনিক মা-বাবাদের বাড়াবাড়ি আচরনে আজ তারা বেজায় বাকরুদ্ধ !

আধুনিক অভিভাবকগণ জীবনে যে মনোবাসনা পূরণ করতে পারেনি, সন্তানদের দ্বারা সেটি বাস্তবায়নের জন্য অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নেমেছে দলবেঁধে । প্রতিটি পরীক্ষার ফলাফল ভালো না হলে যেন অভিভাবকত্বের মানহানি ঘটে । মুক্ত চিন্তা, উন্মুক্ত আলোবাতাস, দামাল ছেলে-মেয়েদের ঐক্য, বাংলার মাটির সোঁদা গন্ধ, বাঙ্গালী সংস্কৃতির চর্চা, সামাজিক আচার, পারিবারিক বন্ধন, এমনকি পূর্বপুরুষদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের কথা, সম্পর্কে এ যুগের ‘এ’ প্লাস প্রাপ্ত শিশুরা খুব বেশি অবগত নয়। গরু-ছাগলকে তো বাপ-দাদারাই লালন-পালন করেছে, তাই নবাগত শিশুদের ডলফিন-ডাইনোসোরকে আবিষ্কার করতে শেখানো হয়। গাঁয়ের মেঠোপথ ধরে, ঝি-ঝি পোকার শব্দ শোনার কাঙ্খিত অভিলাস তাই অপূর্ণই থেকে যায় তাদের কাছে । বাড়ীর দুয়ারে আম-জাম-লিচু গাছতলায় কিশোর-কিশোরীদের স্বাধীনভাবে চলার-বলার-খেলার কোন অধিকারই তাদের থাকেনা । সভ্য-শিক্ষিত (পাষাণ) মা-বাবাদের একটাই লক্ষ্য- ‘ইচ্ছে না করলেও খেতে হবে, মন না চাইলেও পড়তে হবে, পড়তে হবে, পড়তে হবে, হবেই ...., ভাল রেজাল্ট করতে হবে, করতে হবে, করতে হবে, হবেই...., মা-বাবা দু’জনেই যখন উচ্চ শিক্ষিত (কমপক্ষে এম.এ) তবে তো তাদের আরও উচ্চ কোন শিখরে পৌঁছাতে হবে, পৌঁছাতে হবে, হবেই...!

একবিংশ শতাব্দীর রজত জয়ন্তীর ক্রান্তিবেলায় আমাদের শৈশবকালীন স্মৃতিগুলো নিবিড়ভাবে টানছে । আর তাই চোখের সামনেই শিশু-নির্যাতন তথা শিশুর প্রতি অবিচার/ অত্যাচারের ঘটনাগুলো দেখে বড্ড অসহায় হয়ে পড়েছি! শিক্ষার মান উন্নয়নের নামে অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নেমেছে আজ শিক্ষক নামক জাতির বিবেকগণ! নীতি-প্রনেতাগণ চুপটি মেরে থাকবে কেন....? তারা তো প্রতি বছরই সিলেবাস পরিবর্তন করেই চলেছেন, কোচিং বন্ধের ঘোষনা দিচ্ছেন, কালে-ভদ্রে বিদ্যালয় তথা শিক্ষা ব্যবস্থা পরিদর্শন করছেন, শ্রেণীকক্ষে ডিজিটাল সামগ্রী অনুদান দিচ্ছেন, আরও কত কি....! পক্ষান্তরে, প্রাইভেট/ পাবলিক (সরকারি নয় এমন) শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানসমূহ দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির সাথে পাল্লা দিয়ে প্রতি বছর, কখনো আবার দু’বারও বেতন বৃদ্ধি করছেন। একই শিক্ষক বিদ্যালয়ে সাধারন মানের শিক্ষাদান করেন। তারাই আবার প্রাইভেটে কিংবা কোচিং বাণিজ্যে অ-সাধারন বণিক বনে যান । সময়ের পরিক্রমায় শিক্ষকের যশ-খ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে মূহুর্তেই...। অতএব, এবার কোচিং বাণিজ্যে খদ্দের না হয়ে কি উপায় আছে...? কোচিং বিপননের চাহিদা এতটাই তুঙ্গে যে, আগে এলে আগে আসন বরাদ্দ পাবে, নয়ত....এই বুঝি শিক্ষার্থী পিছিয়ে গেলো অসুস্থ প্রতিযোগিতায়!

সরকারি তৎপরতায় ‘সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’ সমূহে ইতোমধ্যে নানামূখী পদক্ষেপ গ্রহন করা হয়েছে, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, সরকারি তৎপরতা, ইত্যাদি। মজার ব্যপার হচ্ছে শিক্ষার্থীর সংখ্যা আনুপাতিক হারে কমে যাচ্ছে, তবে কি ‘ফ্যামিলি প্ল্যানিং এর সু-প্রভাব....? তাহলে সরকারের এই পদক্ষেপসমূহ কাদের জন্য? পক্ষান্তরে, শহুরে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানসমূহে উপচে পড়া ভীড়....! দ্বি-গুন, ত্রি-গুন, চতুর্গুন টাকার বিনিময়ে এমনকি আনলিমিটেড ঘুষের বিনিময়ে হলেও ভর্তি করানো চাই-ই, চাই! এসব লজ্জাকর প্রতিচ্ছবি দেখবার কি কেউই নেই?

শৈশবে আমরা যখন স্কুল কামাতাম, প্রিয় শিক্ষকগণ খোঁজ নিতে বাড়িতে পর্যন্ত আসতেন, শিক্ষার্থীদেরকে স্কুলে পাঠানোর জন্য অভিভাবকগণকে আহ্বান করতেন। আমরা কালে ভদ্রে পরিপাটি হয়ে স্কুলে যেতাম, বেশিরভাগ সময়ই স্কুল পালিয়ে শৈশব উপভোগ করতাম! বড়দের সম্মান করতাম, হা-ডু-ডু খেলতাম, খালে-বিলে মাছ ধরতাম। শাপলা ফুলের মালা গেঁথে দল বেঁধে বাড়ি ফিরতাম। মা-বাবার বকুনি (কখনো কান মলানো) খাবার ভয়ে বিড়াল পায়ে দাদা-দাদীর ঘরে আশ্রয় নিতাম। বিকেল বেলা আবারও সেই মিলনমেলা ! ছায়া-ঢাকা গাঁয়ে বিদ্যুতের আলো পৌঁছেনি তখনো! তার পরেও সামাজিক মূল্যবোধের চর্চার ফলে অতি সাাধারন শিক্ষার্থীর মনে একটা অলৌকিক আলোকছটা বিরাজ করতো । আর বর্তমানে শিশুর শৈশবকে সুকৌশলে হত্যা করা হচ্ছে! কখনো শিক্ষার মান উন্নযনের দোহাই দিয়ে শিশুর প্রতি অমানুষিক চাপ প্রযোগের মাধ্যমে। কখনো আবার সন্তানের উন্নত রেজাল্টের স্বপ্নে বিভোর হয়ে মা-বাবার শহরে পাড়ি জমানোর মাধ্যমে। একই সাথে যৌথ পরিবারের সান্নিধ্য থেকে সন্তানদের বঞ্চিত করার মাধ্যমে!
এখনকার শিশুরা রোজ স্কুলে যায়, বেশির ভাগ স্কুল শুরু হয় ৭.৩০ মিনিটে কিন্তু উপস্থিত হতে হয় ৭.১৫ মিনিটের আগে ।

কোন এক স্কুলের নিয়ম- ‘ কোন কারণে (যানজট, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অসুস্থতা অথবা অন্য কোন অনিবার্য কারণে) ৭.১৬ মিনিট বাজলে সেই শিক্ষার্থীকে আর স্কুলে প্রবেশ করতে দেয়া হয় না, দাঁড়োয়ানকে অনুরোধ করলেও কোন লাভ হয় না বরং কর্তৃপক্ষের নির্দেশানুযায়ী শিক্ষার্থীসহ অভিভাবককে দূর-দূর করে তাড়িয়ে দেয়া হয় ! নামী-দামী স্কুল বলে কথা ! এটাই বুঝি শৃঙ্খলা আর শিষ্টাচার শেখানোর কৌশল! সম্প্রতি, জনৈক অভিভাবকের ঘুম থেকে উঠতে দেরী হওয়াতে সন্তানসহ তাঁকে দাঁড়োয়ান তাড়িয়ে দেয় ! মাত্র ৬ বছরের শিক্ষার্থীরা ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও রোজ ভোর ৬ টায় উঠে, ড্রেস-আপ করে রোজ স্কুলে যায়। নয়তো জরিমানা গুনতে হবে ও পরীক্ষায় নম্বর কম পাবে! ১১ টায় ফেরে আবার ড্রেস চেঞ্জ করে কিছু খায় অথবা খেতে ইচ্ছেও করেনা তাতে করো কিচ্ছু এসে যায় না । এবার অন্য আরেকটি স্কুলে যাবার প্রস্তুতি নিতে হয় । যেহেতু সরকার কোচিং বাণিজ্য বন্ধের ঘোষনা করেছে, তাই কর্তৃপক্ষ স্কুল নামে বহাল তবিয়তে কোচিং বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে; কিল খেয়ে কিল হজম করার মতো সুবোধ শিক্ষার্থী স্কুল নামক কোচিং সেন্টারের ড্রেস গায়ে জড়ায়। কর্তৃপক্ষের নির্দেশানুযায়ী কর্তৃপক্ষকে ত্রুটিমুক্ত করতে তাদের স্বার্থে চোর সেজে নিজেকে উক্ত স্কুলের (আসলে কোচিং) ছাত্রের পরিচয় দিয়ে চলে দিনের পরে দিন , মাসের পরে মাস....!

শিক্ষা অমূল্য ধন বলেই নিরপরাধ শিক্ষার্থীকে টাকার বিনিময়ে ‘সকাল বেলা স্কুল নামক অলিখিত জেলখানায় যেতে হয়, আর কর্তৃপক্ষের বাণিজ্যকে জমজমাট করতে দুপুর হতে সন্ধ্যা পর্যন্ত ছাত্র নামক চোর সাজতে হয় ! মা-বাবার বাড়াবাড়ির কারণে বাড়িতে ফিরেই আবারও অধ্যয়নের প্রস্তুতি নিতে হয় তাঁকে! নয়তো ম্যাডাম (হোম টিউটর) এসে অগ্নি-মূর্তি ধারন করবে ! ঘুমে কাহিল হয়ে নেতিয়ে পড়া জনৈক শিক্ষার্থীকে এবার টাকার বিনিময়ে শিশু নির্যাতন সহ্য করতে হয় রাত ১০/১১ টা পর্যন্ত ! ক্ষুধার চেয়ে ঘুম যখন বেশি প্রয়োজন তখন তাকে জোর করে হলেও মায়ের নির্দেশে খেতে বাধ্য হতে হয়।, এবার দিনশেষে নির্যাতন চালায় পরম পূজনীয় ‘মা’ ! এভাবেই চলতে থাকে সুন্দর শৈশব কেড়ে নেয়া হাজারো কোমলমতি শিক্ষার্থীর প্রতিদিন ! স্যালুট তোমায় হে শিক্ষার্থী ! অভিনন্দন তোমায় বারবার, কৃতজ্ঞতা তোমায় নিজেকে ত্যাগী করে তোলার জন্য....!

এমন অদ্ভুত দৃশ্য দেশের আনাচে কানাচে এখন নতুন কিছু নয়। অথচ অদৃশ্য কারণে যথাযথ কর্তৃপক্ষ নির্বাক কেন? আমরা প্রত্যেকেই মুখে বলি “শিশুরা জাতির ভবিষ্যত”। অথচ সুকৌশলে তাঁদের বর্তমানের ও অতীতের শৈশবকে আমরা প্রতিদিন হত্যা করছি। সম্প্রতি ময়মনসিংহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের মেধাবী শিক্ষার্থী ধ্রুব জিৎ কর্মকার (২২) পড়ালেখার অতিরিক্ত চাপ সহ্য করতে না পেরে স্বেচ্ছায় না ফেরার দেশে পাড়ি জমায়! পক্ষান্তরে মা-বাবা সহ এদেশের শিক্ষার ব্যবস্থার প্রতি রাগ-ক্ষোভ-অভিমান-চাপা কষ্টও নয় কি? এভাবেই ধ্রুব জিৎ কর্মকারের মতো লাখো শিক্ষার্থীর প্রতিদিন অকাল মৃত্যু ঘটে, যা হয়তো বিবেক বর্জিত সমাজকে স্পর্শ করতে পারেনা! অনেক শিক্ষার্থী এভাবেই জীবন্ত লাশ হয়ে বেঁচে থাকে মানুষরুপী শিক্ষিত সমাজের বেষ্টনীতে!

হে সুশীল সমাজ, শিশুর আর্তনাদ শোনার জন্য কেউ কি আছেন.........? তবে জেগে উঠুন সর্বাগ্রে তাঁদের মিছিলে । তাদের ‘প্রাণী’ হিসেবে প্রতিদিন নির্যাতন না করে ‘মানুষ’ হিসেবে বাঁচতে দিন! তাদের বর্ণিল শৈশব কেড়ে নিয়ে আমরা কেবল মানবাধিকার লঙ্ঘনই করছিনা বরং বিবেক প্রতিন্ধীতায় ঠেলে দিচ্ছি। শিক্ষার সার্বিক অব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এভাবেই শিশুর শৈশবকে হত্যা করা বন্ধ হোক এক্ষুণি! আসুন গণসচেতন করে তুলি চারপাশ। সর্বাগ্রে চাই রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা!


লেখক: মো: তানজিমুল ইসলাম
প্রাবন্ধিক ও উন্নয়নকর্মী


মন্তব্য করুন:

সম্পর্কিত খবর